রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাজনীতির কেতাবি সংজ্ঞা আছে মন্দ্র উচ্চারণে, পরিভাষাগত আভরণে। হতে পারে তার সারাৎসার এইরকম – যে নীতি অনুসরণ করে জাতি বা রাষ্ট্র পরিচালিত হয়ে থাকে। কবি কে ? না, কোন অভিধান খুলে বসিনি তাঁর অবয়ব সন্দর্শনের ঈপ্সায়। তিনি কি সেই সত্তা - সাদা কথাকে অর্থাতীত ব্যঞ্জনা দেন, দীন অভিজ্ঞতাকে বৈশ্বিক বা অলোকসম্ভব বিসারতা; যাঁর স্বার্জিত স্বোপলব্ধ জীবনবীক্ষাজাত অকপট বাণী আছে। অন্যরা পদ্যকার গদ্যকার অনেক কিছু, কবি নন। নাকি চিরায়ত বা এমনকি আধুনিক অভিধার বাইরে যিনি কবিতা-প্রতিমাকেই অস্বীকার করেন, দাবি করেন বিষয়হীনতার, ভাষাকে বিনির্মাণ ও নিরক্ত করে ব্যকরণ, অলংকার, রূপক, প্রতীক, উপমা, চিত্রকল্প প্রমুখ রূপ-চিহ্ন এবং আয়ুধকে বিসর্জন দিয়ে কাল্পনিক অভিজ্ঞতাকে অবলম্বনের কথা বলেন তিনিই কবি ! যে দুই কবির অন্তরাত্মার কথা বললাম আমি সেই প্রজ্ঞা থেকে যোজন দূরে যা দিয়ে বলা যায় একি একেরই দুই রূপ না দুই অবধারিত বিপরীত মেরু। আমি দৃষ্টি মেলে দিই এথেন্স নগরীর কালখন্ডে সেই মানুষটির দিকে – প্লেটো, কেন তাঁর আদর্শ রাষ্ট্র বা রাজনীতির পরিসর থেকে কবিকে পাঠালেন দ্বীপান্তরসম নির্বাসনে যাঁর নিজেরই দর্শনের ভাষার প্রাণবন্ত, কাব্যময়তার প্রতিমায় চোখ মেলে বিস্মিত হয়ে যান বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল । প্লেটো কবিদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না কিন্তু তার রচনার মধ্যে কবি আর দার্শনিক সত্তা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।
দিন বসে থাকে না। বসে থাকে না রাজনীতির ক্লাসিকাল সংজ্ঞা। বসে থাকে না কবির আধার হাজার বছরের চর্যাপদে। গণদেবতার অংশ নেওয়ার ওজরে রাজনীতি তার সর্বচরাচরতায় প্রসারিত হয় ক্যাম্পাস থেকে চায়ের পেয়ালায়, প্রেমকুঞ্জ থেকে হননভূমিতে। কবি কি চালিত হন বা প্রভাবিত হন রাজনীতির এই ব্যপ্ত ও ক্রমপ্রসারণশীল আবহে ? যদি বা প্রভাবিত হন, প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে তাঁর অংশগ্রহণ কি কবিসত্তায় কালশিটের ছাপ রেখে
যায় ?
যদি বা প্রত্যক্ষ রাজনীতির অংশীদার হন তাঁর চিন্তা ও প্রকাশের স্বাধীনতায় দলীয় নিয়ন্ত্রণ কি অপ্রতিরোধ্য ? আরও গভীরতর প্রশ্ন, কবির দলীয় রাজনীতির পক্ষ নেওয়ার আবেশ কোন জায়গা থেকে আসছে – সামাজিক বা রাজনৈতিক কমিটমেন্ট না ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্খা ? নাকি এই দু’য়ের কোন জটিলতর রসায়ণ ক্রিয়াশীল হয় ?
এসব প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই সরলরেখায় স্বল্প পরিসরে হয় না। কবির ওপরে রাজনীতির প্রভাব কথাটায় অতিসারল্য-দোষ থাকলেও মানতে অসুবিধা নেই যে কবির সামাজিক চৈতন্য বা বিশেষ রাজনৈতিক ঘটনা কবিতার নির্মাণের একটা প্রেক্ষিত তৈরি করতে পারে। সরলতম উদাহরণ হিজলি জেলে বন্দীদের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনার অভিঘাতে প্রশ্ন-র জন্ম, ১৯৩১ ; কিংবা ঠিক শতবর্ষ আগে জালিয়ানওয়ালাবাগের পরে তাঁর নাইটহুড ত্যাগের অনুসঙ্গে এ মণিহার আমায় নাহি সাজে। স্বাধীনোত্তর কালে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ঘটনা বা অধ্যায় জড়িত আছে নকশালবাড়ির অভিঘাতের সঙ্গে। আমার মনে হয় সেই সময়ে প্রতিষ্ঠিত বা অপ্রতিষ্ঠিত এমন একজন কবিও ছিলেন না যিনি সেই প্রেক্ষিতে অন্তত একখানা কবিতা লেখেননি। তার মধ্যে অনেকগুলি কালের মানদণ্ডে আজও চৈতন্যে ছায়া ফেলে দাঁড়ায় কোন পরুষ বা নির্জনতার পলে। শুধু দু-একখানা কবিতা নয়, সামগ্রিকভাবে কবিতার অঙ্গ থেকে আলগা কাব্যিকতা বা লিরিক মেজাজের প্রত্যাহার ঘটেছে সেই সময় থেকেই। পুরানো কবির কণ্ঠে নতুন স্বরভঙ্গী এনেছে সেই সময়। সত্তরের আগে পরে কিভাবে মনে মরমে বদলে গেছে মণিভুষণের কবিতার শরীরমন, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার রোমান্টিক অতীত বদলে গেছে ক্ষুব্ধ নিঃশ্বাসে। প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণে অভিজ্ঞতার সম্প্রসারণ যে হয় তাতে কোন সন্দেহ নেই, সেক্ষেত্রে কবিতার শরীর (বা অশরীর) সমৃদ্ধ হ’তে অন্তরায় দেখিনা, যদি না সেখানে কমিটমেন্টের জায়গা নেয় উচ্চাকাঙ্ক্ষা। আবার অন্ধ কমিটমেন্ট প্রায়শই শিকার হতে পারে ধর্মপ্রতিম অন্ধতার। তখন কবিতাকে ছুটি দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। আবার প্রয়োগের মাধুরি স্লোগানকেও তো কবিতা বানিয়েছে – আমার বিনিদ্ররাতে সতর্ক সাইরেন বেজে যায় । দিগন্তে মেঘ ঘনায় যখন নিয়ন্ত্রণের শৃঙ্খলা আসে সপ্তরথীর বেষ্টনে। আমি এখানে রাষ্ট্রীয় নয়, দলীয় নিয়ন্ত্রণের কথা বলছি – যদিও ক্ষেত্রবিশেষে এ দুই সমীকৃত হয়ে যায় সন্ধি কিংবা অভিসন্ধির ব্যুহচক্রে। সুকান্ত-র অকাল-প্রয়াণে সেভাবে এই নিয়ন্ত্রণ দাঁত না ফোটালেও সময়-অসময়ে সুভাষ মঙ্গলাচরণ সলিল (চৌধুরি) এই নিয়ন্ত্রণের মূল্য চুকিয়েছেন। কিছুদিন আগে সপ্তর্ষি প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে জয়দেব বসুর ডায়েরি থেকে । আশি-র এই কবি বারেবারেই রক্তাক্ত হয়েছেন পার্টি আর পার্টি নেতৃত্বের অন্তর্বর্তী দূরত্বের মাঝখানে পড়ে। তাঁর রোমন্থনে বোঝা যায় কিভাবে রেজিমেন্টেড পার্টির গঠন এবং নির্বাহ একজন কবির মনের দখলে ক্রিয়াশীল হয়। মায়াকভস্কির আত্মহননের ব্যপ্ত এবং জটিল চালচিত্র নিয়ে কত কথাই লেখা হয়েছে। ৩৬ বছরে শারীরিক হনন-তো একটি মাইলফলক; রাষ্ট্রিয় এবং ব্যক্তিগত স্তরে কিভাবে ক্রমশ একঘরে হয়ে যাচ্ছিলেন, সেই হননমেরুতে কতখানি পার্টি তথা রাষ্ট্র আর কতখানি তাঁর নিজের ব্যক্তিগত ভুবনের বন্ধ-বাক্স তার বিষাদসিন্ধু আমাদের মননে কবি এবং রাজনীতির পরিসরকে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয় এমন এক চর্চা-প্রাঙ্গণে যার কোন পরিসীমা ত্রিমাত্রিক স্থানাংকে আধারিত হওয়ার নয়। বলশেভিক বিপ্লবের পরে কবিতার শৈল্পিক ক্রিয়াকে রাজনৈতিক তথা সমাজতান্ত্রিক ফ্রেমে রিকনস্ট্রাকসনের বিপুল প্রয়াস চালিয়েছিলেন, আবার নিজের আত্মার অন্তস্তলে একই সঙ্গে যেন টের পেতেন রাষ্ট্রসমর্থন ও রাষ্ট্রদ্রোহ; কবিতা কি কম্প্যাটিবল্ হয়ে উঠল না আত্মধ্বংসী ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক দোলাচলের সঙ্গে ? ঘরের দিকে তাকিয়ে যখন মনে আসেন তিনি, সমর সেন, অবিচল রাজনৈতিক বিশ্বাস সত্বেও ছিলেন না প্রত্যক্ষ দলীয় রাজনীতিতে, নিঃশব্দে সরে গেলেন কবিতার পৃথিবী থেকে, তিরিশ-চল্লিশের দশকের অন্যতম বিশিষ্ট কবি তাঁর ৭২ বছরের জীবনের শেষ ৪০টি বছরে লিখলেন না একখানি কবিতাও। রাজনৈতিক অণ্বেষার সঙ্গে কবি-সত্তাকে মেলালেন না কিংবা মেলাতে অপারগ হলেন। স্ববিরোধে কিংবা অঙ্গীকারবদ্ধতায়। নিরাপত্তাকামী মধ্যবিত্ত জীবন-অবস্থাকে ভ্রুকুটি করে ছুটি নিলেন কবিতার পাতা থেকে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যে কবি-কূটনীতিক-রাজনীতিক – পাবলো নেরুদা – ক্লাসিক আর সুররিয়াল নিয়ে যুগপৎ খেলা করে গেলেন প্রেম যৌনতা বিপ্লব এই সমূহের আধার ও আশ্লেষে, চিলি-তে আলেন্দের সমাজতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে অগুস্তো পিনোশের সামরিক অভ্যুত্থানের জেরে ভাড়াটে চিকিৎসকের বিষ-ইঞ্জেকশনে ছেড়ে গেলেন ৬৯ বছরের জীবনকে স্যালুট দিয়ে, তিনি কি বেঁচেই গেলেন মায়াকভস্কি বা সমর সেনের দ্বৈরথ-যন্ত্রণা থেকে ? আব্র রাজনীতির সংস্রব-বর্জিত কবিও কিভাবে রাজনীতির প্রতীক হয়ে ওঠেন মুক্তিকামীর হৃদয় জুড়ে, তা আমরা দেখেছি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে জীবনানন্দের ভূমিকায়। এমনকি আদ্যন্ত রাজনৈতিক নাটকের নামে এসে যায় তাঁরই কবিতার শব্দ – অদ্ভুত আঁধার - কি প্রবল অভিঘাত নিয়ে। আমি আরও একবার বিভ্রান্ত হই কবি এবং রাজনীতির মিথষ্ক্রিয়ার বিচিত্রগামীতায়।
ই-পত্রিকার স্বল্প পরিসরে এই ব্যপ্ত অঙ্গনকে ধরানোর সামর্থ্য বা দুঃসাহস আমার নেই। শেষে আসি অধুনা রাজনীতির স্বপ্নহীন নির্বিবেক চোরাগলিতে, যে সময়ের পাল্লায় ৭০ বা বড়জোর ৮০-র দশক পর্যন্ত কবিরা পড়েননি। কিন্তু তারপরে বিশেষত নয়া শতকের অদ্ভুত আঁধারে যে কবিরা এলেন তাঁদের সামনে চ্যালেঞ্জ ভিন্নতর, যাকে বুঝতে হয়তো আরো কিছুটা সময় চলে যাবে। এই প্রজন্মের কাছে কি হতে পারে দিশা ? প্রায় ৮/৯ বছর আগে অধুনালুপ্ত একটি সংবাদপত্রের রবিবারের সাময়িকীতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বলেছিলেন – দলরাজনীতির চোরা ঘূর্ণিস্রোতে যখন দেশকাল মূল্যবোধের মানদণ্ড খোয়াতে বসেছে, এইসময় একটি জায়মান কবিপত্রের কাজ হবে নিভৃত শিল্পচর্যা ও সমীক্ষার মধ্য দিয়ে সারা জগতের কবিদের মধ্যে একটি নান্দনিক সংহতির নির্মিতি। কিন্তু সারস্বত বাক্যবন্ধের অবয়বে এও কি নয় সরলীকরণ ? তাই রাজনীতি বা রাষ্ট্রের সঙ্গে একজন কবির কী সম্পর্ক হবে সেটা মহামতি প্লেটোর প্রবাদপ্রতিম নিদান সত্বেও আজও নির্ধারিত হয়নি, কোনদিন হবে কি ? প্রায় দৈববাণীর মতো দুখানি চরণ মনে আসে পাকিস্তানের অসাধারণ অকালপ্রয়াত কবি সরোয়ত হুসেন-এর পৃষ্ঠা থেকে – কবিতা যে কোনও জায়গা থেকেই ছেড়ে যেতে পারে তোমাকে.../ বাবার হাতের মতো। মাত্র ৪৯-এ যে কবি মায়ামুক্ত হন চলন্ত ট্রেণের সামনে ঝাঁপ দিয়ে, ১৯৯৬ ।